মহিউদ্দিন আহমদ:
যেমনটি আশঙ্কা করেছিলাম, মাত্র আট দিনের মাথায় তাই ঘটল। চরম বিতর্কিত এবং দলদাস এক সাংবাদিক গত শনিবার ১৮ ডিসেম্বর দেশের প্রচার সংখায় শীর্ষে থাকার দাবিদার কিন্তু দামে সস্তা, একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এক কলামে ওয়াশিংটনে অবস্থিত আমাদের দূতাবাসকে, বিশেষ করে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে র্যাব এবং এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ থামাতে ব্যর্থতার অভিযোগে নোংরাভাবে আক্রমণ করেছেন। এ কলামিস্ট নতুন দিল্লিতে আমাদের প্রেস কর্মকর্তার সাফল্যের বয়ানও দিয়েছেন। এ কলামটি পড়ে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, এই প্রেস কর্মকর্তাকে নতুন দিল্লি থেকে ওয়াশিংটনে বদলি করলে কেমন হয়? তিনি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিংকেনকে মুহূর্তে জয় করে ফেলবেন? এ কলামটি পড়ে আমার একটু হাসিও পেল; বঙ্গবন্ধু, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার জামানায় তিন তিনজন পত্রিকার সম্পাদক বিদেশে আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশের জন্য কেমন বিপর্যয় ছিলেন তাও মনে পড়ল। তাই কলামটি পড়ে মনে একটু হাসি এসে গেল।
এ দলদাস কলাম লেখক ওয়াশিংটনে আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রদূত সম্পর্কে একটু খোঁজ নিলে তার এমন অজ্ঞতা হয়তো প্রকাশ পেত না। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে ঢাকায় কয়েক বছর ‘বিমসটেক’-এর সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন। তার আগে ছিলেন প্যারিসে আমাদের রাষ্ট্রদূত। এমন অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কর্মকর্তা কেন ব্যর্থ হলেন, তা এ কলাম লেখক ইস্যুর গভীরে গিয়ে খোঁজ করেননি। কলামের নামে তিনি একটি রচনা লিখেছেন যা তার মতো একজন লেখকের জন্য স্বাভাবিক। এ কলাম লেখক খোঁজ করেননি, আমাদের কূটনীতি দেখভাল করার জন্য যে চার চারজন মন্ত্রী আছেন, তারা কেন এমন চরমভাবে ব্যর্থ হলেন? কলাম লেখক অবশ্য বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটু হালকাভাবে ধরেছেন। কিন্তু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী এবং কয়েক মাস আগে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিয়োগ পাওয়া প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন, এরা কেন মার্কিন ‘স্যাংশন’ ঠেকাতে পারলেন না? এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জিয়াউদ্দিন অনেক বছর ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। কলাম লেখক কয়েক বছর আগে টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর এবং যুবলীগ নেতা একরামুল হককে চলমান গাড়িতে, তার স্ত্রী বা মেয়ের সঙ্গে কথা বলারত অবস্থায় যে র্যাব গুলি করে মেরে ফেলল এবং যা বিবিসি বাংলা প্রায়ই প্রচার করে, তা দলদাসটি র্যাবের বন্দনা করতে গিয়ে সম্পূর্ণ ভুলে গেলেন!! আমি যতটুকু শুনেছি, এই একটি ঘটনা মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টকে স্যাংশন আরোপের ক্ষেত্রে খুব প্রভাবিত করেছে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রশ্নে আরও আগের কিছু কথা। কয়েক বছর আগে আল জাজিরায় প্রচারিত মেহেদী হাসান যে সাক্ষাৎকারটি গওহর রিজভীর নিয়েছিলেন, সেখানে মেহেদী হাসানের প্রথম প্রশ্নটিই ছিল, বাংলাদেশ কি উত্তর কোরিয়ার মতো এক পার্টি রাষ্ট্র হতে চলেছে? টিম সেবাস্টিয়ান নামের আর এক বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক এই একই গওহর রিজভীকে আর এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার ইস্যুতে দারুণভাব নাজেহাল করেছিলেন। গওহর রিজভীকে কৃতিত্ব দিতে হয়, তিনি একবারও এ দুই সাক্ষাৎকারের কোথাও এক সেকেন্ডের জন্যও মেজাজ হারাননি। কিন্তু আমার মনে হয়, তিনি তার এ তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা প্রধানমন্ত্রীকে জানাননি। আমাদের আর এক মন্ত্রী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হককেও ২০১৯ সালে জেনেভাতে বাংলাদেশে মানবাধিকার ইস্যুতে ‘কমিটি এগেইন্সট টর্চার’ (Committee Against Torture, CAT)-এর এক শুনানিতে প্রায় বিব্রত করে ছেড়েছিল।
এ পর্যায়ে অতি সঙ্গত এবং যথার্থ প্রশ্ন, ব্যর্থতা কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, রাষ্ট্রদূত না রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের? কয়েকদিন আগে ৭১-এর এক টকশোতে সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলছেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা তো মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক মানবাধিকার রিপোর্টে গত ২০ বছর ধরে বলা হচ্ছে! কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীরা কি এসব রিপোর্টকে কোনোদিন গ্রাহ্য করেছেন? কথা আরও আছে। এই যে গত বছর অক্টোবরে যখন ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট এবং মাইক পম্পিও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন দশ দশজন প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর পম্পিওকে লেখা এক চিঠিতে বাংলাদেশে ‘র্যাব’ কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে পম্পিওকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছিলেন। তারপর ৩১ আগস্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর মার্কিন কংগ্রেসের টম লেন্টস কমিশনের যে ‘হিয়ারিং’ হলো, এতে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের কী প্রতিক্রিয়া ছিল? এসব মার্কিন উদ্বেগের কথা কি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছিল? আমার আশঙ্কা, তাকে জানানো হয়নি। জানানো হয়নি, কারণ আমার ধারণা, শেখ হাসিনা ক্রিটিক্যাল কিছু শুনতে পছন্দ করেন না। আর আমাদের কোনো মন্ত্রীরই এমন ক্রিটিক্যাল রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনার সাহস নেই।
দুই.
গত ১৩ ডিসেম্বর দৈনিক মানবজমিনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিংকেনের একটি উক্তি পড়লাম, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রে মানবাধিকার, যেখানে লঙ্ঘন সেখানেই পদক্ষেপ’। এ কথাটি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সব নেতাই তো গত বছর জো বাইডেনের নির্বাচনি প্রচারণার শুরু থেকে বলে আসছেন। উচ্চস্বরে বলা এসব বার্তার কিছুই কি আমাদের নেতা-মন্ত্রীদের কানে পৌঁছায়নি? ডেমোক্র্যাটিক পার্টি সব সময় মানবাধিকার ইস্যুকে রিপাবলিকান পার্টির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়, তারা অনুন্নত দেশগুলোর প্রতি বেশি সংবেদনশীলও, এটা কি নতুন কোনো আবিষ্কার? দুই ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট কেনেডি-জনসনের আমলে এ দেশের ‘ব্ল্যাক’রা প্রথম ভোটাধিকার পায়, প্রেসিডেন্ট কার্টারকে তার নমনীয়তার জন্য খ্রিষ্টান মিশনারির সঙ্গে তুলনা করা হতো, আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনই ২০০০ সালে প্রথম বাংলাদেশ সফর করেন এবং বারাক ওবামা ব্ল্যাক হওয়া সত্ত্বেও ডেমোক্র্যাটিক পার্টিই তাকে প্রেসিডেন্ট পদে নমিনেশন দিয়েছিল।
ডেমোক্র্যাটিক পার্টির জো বাইডেন ক্ষমতায় এলে তাদের নীতি-আদর্শ, কর্মপরিকল্পনা কী হবে, বাংলাদেশের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, এসবের ওপর কি কোনো ব্রিফিং পেপার তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দিয়েছিল বা মৌখিকভাবে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছিল? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমাদের কর্মজীবনে তো আমরা এমন করেছি। এখনো তো আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন করার কথা। আমাদের বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন একজন আউটস্টান্ডিং পেশাদার কূটনীতিবিদ। তার পক্ষে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নতুন সরকারের কর্মপরিকল্পনা, নীতি-আদর্শ না বোঝার কথা নয়। কিন্তু এখানে মৌলিক প্রশ্ন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বন্ধ করা জরুরি, এমন সুপারিশ কেউ কি প্রধানমন্ত্রীকে এই এক বছরে করেছেন? নাকি, এখানেও সাহসের অভাব ছিল? গত শুক্রবার, ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টা ৩০-এর প্রবাহ অনুষ্ঠানে ‘র্যাব’ এবং এর সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর আরোপিত স্যাংশনের ব্যাকগ্রাউন্ড, এর কাছে এবং সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিবিসির সংবাদদাতা কাদির কল্লোলের তথ্যবহুল ও যুক্তিনির্ভর ১২-১৪ মিনিটের একটি দীর্ঘ বিশেষ প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। এ প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকার ছিল তিনজন বিশেষজ্ঞের, বোস্টন থেকে জাভেদ ইকবাল, ড. আলী রিয়াজ এবং আর একজন মহিলার, নাম ভুলে গেছি। জাভেদ ইকবাল মার্কিন স্যাংশনের ওপর গবেষণা করেন। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, কীভাবে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট যৌথভাবে প্রয়োজনীয় আলাপ আলোচনার পর এসব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। তার কথায় আবার পরিষ্কার হলো, বাংলাদেশের ওপর আরোপিত এ স্যাংশন হঠাৎ নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়। তাদের আলোচনায় আরও বুঝলাম, বাংলাদেশের ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এন্টনি ব্লিংকেনের আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনের সঙ্গে টেলিফোনের আলোচনা অবশ্যই একটি ইতিবাচক ঘটনা; কিন্তু স্যাংশন প্রত্যাহার? বিনিময়ে ‘র্যাব’কে জবাবদিহিতার আওতায় আনার একটি ওয়াদাও থাকতে হবে বাংলাদেশের।
তিন.
আমাদের তিনজন মন্ত্রীকে এ স্যাংশনের ওপর খুব ‘অ্যাক্টিভ’ দেখলাম। প্রত্যাশিতভাবেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী; তার পরে আইনমন্ত্রী এবং তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এখন বেশি কথা বলছেন না। তো তারা দেশের ভেতরের মানুষজনকে সফলভাবেই তাদের কথাবার্তা খাইয়েছেন। কিন্তু এ সমস্যাটি দেশের হলেও তারা গ্রাহ্য করেননি। সমস্যা হলো, তারা যত সহজে দেশের মানুষজনকে অবজ্ঞা-অবহেলা করতে পারেন, তা কি তারা বিদেশে করতে পারবেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাতে পারবেন?
এ ইস্যুতে আমি কিছু কিছু মানুষের মধ্যে দারুণ এক জাতীয়তাবোধ লক্ষ করেছি। কিন্তু এখানেও একটি যথার্থ প্রশ্ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের এমন বেইজ্জত করল, কিন্তু তারপরও তো কোনো বাংলাদেশি প্রতিবাদে এ দেশটি ছেড়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেনি!! বা, ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসে ভিসার জন্য লাইন ছোট হয়নি। মন্ত্রী সাহেবদের বলি, জনাবরা, আপনাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য এখনো যে এ দেশটি ‘আলটিমেট ডেস্টিনেশন’। সবচেয়ে বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে এ দেশটিতেই অবস্থিত। আমেরিকার মানবাধিকার নিয়ে হাজার হাজার প্রশ্ন করা যেতে পারে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ‘র্যাব’-এর গুম, খুন, ক্রসফায়ার, এনকাউন্টারের যৌক্তিকতার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর লাখ লাখ লোকের গুম হয়ে যাওয়ার এবং পুলিশের গুলিতে হাজার হাজার লোকের মৃত্যুর উদাহরণ দিতে পারেন, কিন্তু বোটম লাইন হলো, তারপরও একজন বাংলাদেশি ভয়ে ডরে এ দেশ ত্যাগ করে অন্য কোনো দেশে চলে যাচ্ছে না। আর, আমাদের কারও ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, এ দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কৃষ্ণাঙ্গ লোকদের ওপর চলমান অন্যায় অবিচারের অপরাধবোধ থেকে রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে থাকা আট-দশ বছরের এক শিশুর সামনে হাঁটু গেড়ে মাফ চাইতে পারেন। বাংলাদেশে কোনো মন্ত্রী-নেতা এমন কিছু করবেন, ভাবতে পারেন? গত মঙ্গলবার ১৬ ডিসেম্বর, একটি পত্রিকায় প্রকাশিত কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তমের কলামের শিরোনাম ছিল, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, লজ্জার হাত থেকে দেশকে বাঁচান’। আমার আজকের এ কলামটির শিরোনামও তা হতে পারত। মুক্তিযুদ্ধে আমার কিঞ্চিৎ ভূমিকা ছিল। তাই এ দেশটির ওপর অতি সামান্য আঘাত এলেও আমার রক্তক্ষরণ হয়।
‘শিউলীতলা’, উত্তরা; রোববার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১।
লেখক: পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব; কলাম লেখক